[taken from http://www.mukto-mona.com/Articles/zafar_iqbal/ghrina_theke_mukti.htm]
ঘৃণা থেকে মুক্তি চাই
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
বছর ত্রিশেক আগে আমি যখন আমেরিকায় পিএইচডি করছি, তখন স্টিভ মোজলে নামে আমার একজন আমেরিকান বন্ধু কলেরা হাসপাতালে কাজ করতে এসেছিল। এখানে কয়েক মাস কাজ করে সে যখন আমেরিকা ফিরে গিয়েছে, তখন একদিন আমাকে বলেছিল, ‘উনিশ শ একাত্তর সালে তোমাদের বাংলাদেশে যা ঘটেছে, সেটা এত অবিশ্বাস্য রকমের নিষ্ঠুর যে আজ থেকে দশ-বিশ বছর পর সেটা আর কেউ বিশ্বাস করবে না।’ তার কথার গুরুত্ব আমি তখন ধরতে পারিনি, এখন পারছি। সত্যি সত্যি একাত্তরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাদের আজ্ঞাবহ অনুচরদের নিয়ে এই দেশে কী করেছিল, সেটি বললে সভ্য জগতের মানুষেরা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়। বাইরের মানুষের কথা ছেড়ে দিই, এই দেশের নতুন প্রজন্ন পর্যন্ত পাকিস্তান নামক দেশটিকে জানে একটি ক্রিকেট টিমের দেশ হিসেবে, মোবাইল কোম্পানির বড় কর্মকর্তার দেশ হিসেবে। আমরা−শুধু আমরা, যারা সেই একাত্তরকে নিজের চোখে দেখেছি, তারা জানি সেটি কী ভয়ঙ্কর ধরনের নিষ্ঠুরতা ছিল, কী অবিশ্বাস্য নৃশংসতা ছিল। এই দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের একজনও ছিল না, যারা তার কোনো একজন আপনকে হারায়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভেতর এক কোটি মানুষকে যদি শুধু প্রাণ বাঁচানোর জন্য অন্য দেশে গিয়ে শরণার্থী হতে হয়, তাহলেই যে কেউ অনুমান করতে পারবে বিষয়টা কত ভয়ঙ্কর ছিল। যদি তারা শরণার্থী হয়ে পালিয়ে না যেত, তাহলে যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আর তাদের আজ্ঞাবহ অনুচররা তাদের প্রত্যেককে হত্যা করত, সেটা কী সবাই জানে?
আমরা যারা একাত্তরকে নিজের চোখে দেখেছি, শুধু তারাই জানি ঘৃণা কাকে বলে। এই পৃথিবীতে খুব বেশি মানুষ নেই, যারা আমাদের মতো করে সেই ঘৃণাকে অনুভব করতে পারবে। এই ঘৃণা শুধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য নয়, এই ঘৃণা শতগুণে বেশি একাত্তরের রাজাকার-আল-বদর, আল-শামসদের জন্য, যার বেশির ভাগ ছিল জামায়াতে ইসলামীর সদস্য। আমার কাছে কেউ যখন জানতে চায়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার জন্য তারা কোন বই পড়বে, আমি তখন তাদের শুরু করার জন্য যে চারটি বইয়ের নাম বলি তার একটি হচ্ছে পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিকের লেখা উইটনেস টু সারেন্ডার বইটি। সেই বইয়ের এক জায়গায় লেখা আছে, পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদেরা সরাসরি মিলিটারি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছিল যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে কাজ করার জন্য রাজাকার-আলবদর-আল শামস নামে যে আধা সামরিক বাহিনী তৈরি করেছে, সেটা আসলে জামায়াতে ইসলামীরই বাহিনী। সেই একাত্তরেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীই নির্দেশ দিয়েছিল, ব্যাপারটা যেন এত খোলামেলাভাবে প্রকাশ না পেয়ে যায়।
সেই জামায়াতে ইসলামীর বদর বাহিনীর কমান্ডার এখন বলছে, এ দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই? রক্তস্মাত এই দেশে সেই মানুষগুলো এত বড় দুঃসাহস কোথা থেকে পায়?
২.
১৯৭১ সালে দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে যে আধাসামরিক বাহিনীগুলো তৈরি করা হয়েছিল, তার মধ্যে রাজাকার বাহিনী ছিল সমাজের একেবারে নিচু শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে। সেই একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এত হম্বিতম্বির পরও কোনো আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়নি। যারা যোগ দিয়েছিল, তারা ছিল ভীতু ও কাপুরুষ, একজন মুক্তিযোদ্ধা এক-দুজন নয়, একসঙ্গে এক-দুই শ রাজাকারকে বন্দী করে ফেলতে পারত। সেই তুলনায় বদর বাহিনী ছিল অনেক ভয়ঙ্কর। তার কারণ, এই বাহিনীর সদস্য ছিল জামায়াতে ইসলামীর সে-সময়কার ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যরা। একজন সাধারণ মানুষ যত বড় অপরাধীই হোক, অন্য একজন মানুষকে হত্যা করতে ইতস্তত করে, অপরাধ বোধে ভোগে কিন্তু এই বদর বাহিনী ইতস্তত করত না, তাদের ভেতর কোনো অপরাধবোধ ছিল না। কারণ তারা হত্যাযজ্ঞ চালাত ইসলামের নামে, পাকিস্তানের নামে। একাত্তরে, সমগ্র পাকিস্তান আল-বদর বাহিনীর কমান্ডার মতিউর রহমান নিজামীর দেওয়া দুই-একটি ‘বাণী’ পড়লেই সেটা বোঝা যায়। যেমন যশোরে রাজাকার বাহিনীর সভায় বলা হয়েছিল, ‘আমাদের প্রত্যেককে একটা ইসলামি রাষ্ট্রের মুসলমান সৈনিক হিসেবে পরিচিত হওয়া উচিত এবং মজলুমকে আমাদের প্রতি আস্থা রাখার মতো ব্যবহার করে তাদের সহযোগিতার মাধ্যমে ওই সব ব্যক্তিকে খতম করতে হবে, যারা সশস্ত্র অবস্থায় পাকিস্তান ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত আছে!’ (প্রথম আলো, ৩০ অক্টোবর ২০০৭) তারা সবাই মিলে এই দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ‘খতম’ করেছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের একেবারে শেষমুহুর্তে যখন আবিষ্ককার করেছে সত্যি এ দেশটি স্বাধীন হতে যাচ্ছে, তখন যেন এই দেশটি মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য এই দেশের বুদ্ধিজীবীদের ‘খতম’ করেছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের এত বছর পরও সেটি নিয়ে তাদের ভেতরে কোনো অনুশোচনা নেই, কোনো অপরাধবোধ নেই। এখন দেখছি তাদের ভেতরে এক ধরনের অহঙ্কার আছে! পূর্ব পাকিস্তান আল-বদর বাহিনীর কমান্ডার আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়, এই দেশে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী নেই, ছিল না!
কেমন করে এটা ঘটেছে আমরা সেটা খানিকটা জানি, খানিকটা অনুমান করতে পারি। ১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে এসে আমি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছি; কিছুদিনের ভেতরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ আমাকে একটা তদন্ত কাজে লাগিয়ে দিল। ছাত্রদলের ছেলেরা তখন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের তেজস্বী কন্ঠস্বর। তারা কোনো একটা অনুষ্ঠানে রাজাকারদের গালাগাল করেছে, ইসলামী ছাত্রশিবিরের একজন ছাত্র তখন একজন ছাত্রনেতাকে চাকু মেরে দিয়েছে। আমি আমাদের তদন্ত কমিটি নিয়ে তদন্ত করে রিপোর্ট দিয়েছি। সেই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে শিবিরের ছেলেটিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্ককার করা হয়েছিল।
তারপর এই দেশে খুব বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাজাকারদের বিপক্ষে কথা বলার জন্য যে তেজস্বী ছাত্রটি চাকু খেয়েছিল, তার রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনে জেতার জন্য জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে একটা জোট করল। আমি খবরটি একবার, দুইবার, একশবার পড়েও বুঝতে পারি না, যে জিয়াউর রহমান এই দেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার, তার হাতে তৈরি দল স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট করেছে? সেটা কীভাবে সম্ভব? নির্বাচনে জেতা কী এতই জরুরি? আদর্শ বলে কিছু নেই? দেশের জন্য মমতা বলে কিছু নেই?
এ রকম সময়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নামকরণ নিয়ে এক ধরনের উত্তেজনা। একদিন আমি সবিস্নয়ে দেখি ছাত্রদলের চাকু খাওয়া সেই ছেলেটি ইসলামী ছাত্রশিবিরের ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছে। বক্তৃতার বিষয় অত্যন্ত সহজ ও সরল−আমাকে কুৎসিত গালাগাল। আমি নিজের কানে শুনছি, অবিশ্বাস করি কীভাবে?
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটা ঘটেছিল, সারা দেশে সেটা ঘটতে লাগল। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান ভুঁইয়া বদর বাহিনীর কমান্ডার মতিউর রহমান নিজামী আর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের পাশে বসে দেশ শাসন করতে লাগলেন। আমি রাজনীতি বুঝি না, রাজনৈতিক বিশ্লেষকও নই, কিন্তু আমি ১৯৭১ সালের জামায়াতে ইসলামীকে দেখেছি, তাই আমি জানি এই দলটি কী! আমি খবরের কাগজে একদিন লিখেছিলাম, জামায়াতে ইসলামী একদিন বিএনপির হাড়-মাংস-মজ্জা শুষে খেয়ে তার চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাবে।
বিএনপি ও তার হর্তাকর্তারা কি সেই ডুগডুগির আওয়াজ শুনছেন?
৩.
তবুও হিসাব মিলতে চায় না। জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিএনপি যেভাবে দেশ শাসন করেছে, সেটা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কময় দেশ শাসন। শুধু যে লুটপাট এবং লুন্ঠন তা নয়, জঙ্গি বাহিনীকে সারা দেশে পাকাপোক্তভাবে শিকড় গেড়ে বসিয়ে দেওয়া, দেশের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে নিজেদের মানুষ বসিয়ে দেওয়ার কাজটিও তারা ভালোভাবে শেষ করেছে। কিন্তু সেই পাঁচ বছরের শাসনামলেও বদর বাহিনীর কমান্ডার আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মুখ থেকে যে কথাগুলো বের হয়নি, এখন কেন সেগুলো বের হচ্ছে? প্রকাশ্য টেলিভিশনে সাবেক এক সচিবের মুখ দিয়ে সেগুলো কেমন করে সমর্থিত হচ্ছে? এই সময়টা কি বিশেষ একটা সময়?
আমার এখন মনের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করে। গোয়েন্দা বাহিনী থেকে এই দেশের সব টেলিভিশন চ্যানেলে একটা কাগজ পাঠানো হয়েছে, সেখানে এই দেশের বিশেষ এক ধরনের বুদ্ধিজীবী আর তাদের টেলিফোন নম্বর দেওয়া আছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তারা যখন কোনো টক শো করবে, তখন অবশ্যই এই তালিকা থেকে একজন বুদ্ধিজীবীকে রাখতে হবে। সেই বুদ্ধিজীবীর তালিকা দেখে আমার আক্কেললগুডুম হয়ে গেছে, সাহস করে কোনো একটা পত্রিকা যদি সেই তালিকা প্রকাশ করত, তাহলে দেশের মানুষেরও আক্কেলগুডুম হয়ে যেত। এর বড় অংশ হচ্ছে উগ্র ডানপন্থী, যদি এটাই এই দেশের বর্তমান রাষ্ট্রক্ষমতার মতাদর্শ হয়ে থাকে, তাহলে অনুমান করতে সমস্যা হয় না, শাহ আবদুল হান্নান বা মুজাহিদের ঔদ্ধত্যের শক্তিটুকু কোথায়।
তবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর আমার বিশ্বাস আছে। এই মানুষগুলোর ধৈর্য ধরার ক্ষমতা অসাধারণ, কিন্তু যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন অবস্থার পরিবর্তন করে। মাইনাস টু, প্লাস ওয়ান, সিল দেওয়া সংস্কার, ঝড়যন্ত্র থিয়োরি−এই বিষয়গুলো কেউ বুঝিয়ে দেওয়ার আগেই তারা বুঝে ফেলে। আল-বদর বাহিনীর কমান্ডার আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের এবারকার বক্তব্যটি এই দেশের মানুষের কাঁচা নার্ভকে স্পর্শ করেছে। যখন টেলিভিশনে এটা প্রচার করা হয়েছে তখনই আমার কাছে অসংখ্য টেলিফোন, এসএমএস এসেছে সেটা দেখার জন্য। এই দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী বদর বাহিনীকে আমি এত ঘৃণা করি যে তাদের যেন দেখতে না হয় সে জন্য আমি টেলিভিশনের কাছে পর্যন্ত যাই না। আমি জানি আমি একা নই, এই দুঃখী দেশটার জন্নপ্রক্রিয়া যারা দেখেছে, তাদের কারও পক্ষে এই মানুষগুলোর চেহারা দেখা সম্ভব নয়।
মনে হচ্ছে দেশের মানুষের হঠাৎ করে এক ধরনের আত্মোপলব্ধি হয়েছে, সবাই ভাবছে, এ কী হলো? যে মানুষগুলো এই দেশের স্বাধীনতাই চায়নি, যারা এই দেশের সোনার ছেলেদের আক্ষরিক অর্থে জবাই করেছে, তারা দাবি করছে, এই দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধ হয়নি? এই দেশে কোনো জেনোসাইড হয়নি? যে তথ্যগুলো আমাদের প্রজন্ন নিজের চোখে দেখে এসেছে, কয়েকদিন থেকে সেই তথ্যগুলো খবরের কাগজে আসতে শুরু করেছে। একাত্তরের পরের প্রজন্ন দেখতে শুরু করেছে পাকিস্তানের নামে আর ইসলামের নামে এই দেশে কত বড় নৃশংসতা করা হয়েছে। তারা কি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারবে?
৪.
আগামী ডিসেম্বর মাসের ৯ তারিখ নিউইয়র্কের কিন ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশের জেনোসাইডেরে ওপর একটা সেমিনার হতে যাচ্ছে। এই সেমিনারটির জন্য খাটাখাটুনি করছে নতুন প্রজন্েনর কিছু তরুণ। আমার জানামতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে একটি সেমিনার এই প্রথম। সেমিনারে আলোচ্য বিষয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার পাশাপাশি এই দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার কথাগুলো উঠে আসবে। সেনাবাহিনীর আজ্ঞাবহ রাজনৈতিক দল, তাদের তৈরি আধা সামরিক বাহিনী এবং সেই বাহিনী প্রধানদের নাম হিসেবে গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদের নামও উঠে আসবে। সেই নামগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে লিপিবদ্ধ হবে, সেমিনারের পঠিত প্রবন্ধ হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে সারা পৃথিবীর তথ্যসম্ভারে সারা জীবনের জন্য সংরক্ষিত হয়ে যাবে। আমরা যখন বেঁচে থাকব না, তখনো আমাদের পরবর্তী প্রজন্ন সেই আনুষ্ঠানিক তথ্যের রেফারেন্স যুগযুগ ধরে ব্যবহার করতে পারবে। বাংলাদেশের সত্যিকারের ইতিহাস রক্ষার জন্য এটি খুব বড় একটি উদ্যোগ, উদ্যোক্তাদের জন্য রইল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
৫.
খবরের কাগজে দেখেছি আমাদের বিজয়ের মাসে ডিসেম্বরের ৩ তারিখ মুক্তিযোদ্ধা মহাসমাবেশ হবে। এই দেশের নতুন প্রজন্ন যদি দেশকে ভালোবাসতে চায়, তাহলে তাদের দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জানতে হবে। এই দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মতো গৌরবের বিষয় আর কী হতে পারে? আমরা তাই দেশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনানোর একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। সেই অনুষ্ঠানে আমরা যখন যে মুক্তিযোদ্ধাকে অুনরোধ করেছি তারা তাদের শত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দিয়ে ছোট বাচ্চাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলে আমি আবিষ্ককার করেছি, তাদের অনেকের বুকের ভেতর এক ধরনের অভিমান রয়ে গেছে। যে দেশকে রক্ত দিয়ে স্বাধীন করেছেন, সেই দেশে যুদ্ধাপরাধী গাড়িতে পতাকা উড়িয়ে ঘুরে বেড়ায়, তাঁরা যদি অভিমান না করেন তাহলে কারা করবে?
আমার খুব ভালো লাগছে যে এবার এই দেশের মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অভিমানের কথা ভুলে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন। সব সেক্টর কমান্ডার বলছেন, অনেক হয়েছে। আর নয়। তাঁরা এই দেশকে জঞ্জালমুক্ত করবেন। এই দেশের অবস্থা এমন হয়েছে যে সত্যি কথাটিও কেউ বলতে পারে না, তার মধ্যে একটা রাজনীতির গন্ধ খুঁজে বের করে সত্য কথাটিরও ভুল অর্থ করে ফেলা হয়। মুক্তিযুদ্ধের বীর সেক্টর কমান্ডারদের সেই ভয় নেই, তাঁরা এই দেশের সবচেয়ে সম্মানী মানুষ, তাঁদের নেতৃত্বে এই দেশে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম হয়েছে। তাঁদের মুখের কথা এই দেশের মানুষ বিশ্বাস করে। আমরা চাই, তাঁরা আবার আমাদের একটুকু নেতৃত্ব দিন, এই দেশের ইতিহাস অনেক গৌরবের, কলঙ্কের অংশটুকু অপসারণ করার দায়িত্বটুকু তাঁরা গ্রহণ করুন। তাঁদের সঙ্গে এই দেশের সব মানুষ আছেন, থাকবেন। নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, তারাও নীতিগতভাবে মনে করে যুদ্ধাপরাধীদের এই দেশে নির্বাচনের অধিকার নেই। সারা দেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের আত্মোপলব্ধি, এক ধরনের জাগরণের সৃষ্টি হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে পরাস্ত করার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। স্বাধীনতার তিন যুগ পর তাঁরা দ্বিতীয়বার স্বাধীনতার শত্রুদের পরাস্ত করার নেতৃত্ব নেবেন, আমরা সেটুকু আশা করি। তাঁদের পাশে থাকার জন্য এ দেশের সব ছাত্র-শিক্ষক-জনতা প্রস্তুত হয়ে আছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই দিনগুলোর কথা স্নরণ করলে আমরা যেন এই দেশের মানুষের ত্যাগ বীরত্ব আর অর্জনের কথা মনে করার আনন্দটুকু অর্জন করতে পারি। স্বাধীনতাবিরোধীদের নৃশংসতার কথা মনে করে আমরা আর ঘৃণা, ক্রোধ আর ক্ষোভ অনুভব করতে চাই না−সেটুকু একবারের মতো আমরা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চাই।
এ রক্তস্মাত দেশের রক্তের ঋণ আমরা চিরতরে শোধ করে দিতে চাই।
সৌজন্যঃ প্রথম আলো
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments:
Post a Comment